বদলে যাওয়ার তিনবছর

আমরা আগে পরিচয় গোপন করে পড়তাম। এখন নিজেদের পরিচয়েই পড়তে পারছি। সরকার থেকে আমাদের সাইকেল, স্কুল ব্যাগ দিয়েছে। আমাদের আর কষ্ট করে পড়তে হয় না

সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, পঞ্চগড়

মাত্র ৩ বছরে বদলে গেছে পঞ্চগড় জেলার বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের নতুন বাংলাদেশিদের জীবন ব্যবস্থা। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। অবহেলিত অধিকার বঞ্চিত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ায় আধুনিকতার ছোঁয়ায় অন্যান্য বাংলাদেশিদের মতো মূল স্রোত ধারায় ফিরে এসেছে। দেশের নাগরিকত্বের পাশাপাশি নাগরিক সেবাসহ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা পেয়ে উচ্ছ্বসিত ৬৮ বছর পিছিয়ে থাকা নতুন বাংলাদেশিরা। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।

পিতার হাতে চুক্তি, মেয়ের হাতে মুক্তি

১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আলোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ কুটনৈতিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলো বিনিময় হয়। উভয় দেশের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা স্থল সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে ছিটমহলগুলো বিনিময় করেছেন। তার হাত ধরেই দীর্ঘ ৬৮ বছরের অবহেলিত বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পান ছিটমহলবাসীরা। তাই তো ছিটমহলবাসীর মূল স্লোগান এখন ‘পিতার হাতে চুক্তি, মেয়ের হাতে মুক্তি।’ পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলা, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় গাড়াতি, শিংগিমারী, নাটকটোকা, বেহুলাডাংগা, বালাপাড়া খাগড়াবাড়ি, কোট ভাজনি, দহলা খাগড়াবাড়ি, কাজলদিঘী, পুটিমারি, নাজিরগঞ্জ, দৈখাতা ও শালবাড়িসহ বিলুপ্ত ৩৬ ছিটমহলের ৪৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় প্রায় ২০ হাজার মানুষ নাগরিকত্ব পেয়েছেন। গত ৩ বছরে ঘরে ঘরে বিনামূল্যে বিদ্যুত্ সংযোগ, শিক্ষা বিস্তারে ৩২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নির্মাণ, আশ্রায়ণ প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির সহায়তা, কৃষি সহায়তা, জমির মালিকানা হস্তান্তর, ভোটার নিবন্ধন, মসজিদ মন্দির, হাট-বাজার, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে রাস্তাঘাট, সেতু-কালর্ভাট নির্মাণ, ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, কমিউনিটি ক্লিনিক ও কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ, পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনসহ সরকারের সকল বিভাগের নাগরিক সেবা প্রদান করায় বদলে গেছে তাদের এলাকার চিত্র।

বদলে গেছে অনেকখানি!

স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) মাধ্যমে প্রায় ৯৫ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জেলার ৩ উপজেলার ৩৬টি ছিটমহলে ২৩০ কিলোমিটার বিদ্যুত্ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। ৬ হাজার পরিবারে মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের আলো। জেলার বোদা উপজেলার বিলুপ্ত নাজিরগঞ্জ দইখাতা ছিটমহলের করতোয়া নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ২৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও নলকূপ স্থাপন করেছেন। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং সার্বিক নিরাপত্তার জন্য ২টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলে ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এরইমধ্যে ৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজ শেষ হয়েছে। ৩৬টি ছিটমহলে বেসরকারিভাবে প্রায় ৩৬টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। সাবেক ছিটমহলগুলোতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের জন্য কয়েকটি ডাকঘর স্থাপন করা হয়েছে। তারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে। এমনকি কেউ কেউ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতাও করছেন। এর ফলে মূল ভূখণ্ডের সাথে একই স্রোতধারায় আসছে

নতুন বাংলাদেশিরা। মূল ভূখণ্ডের সাথে মিলে যাওয়ার পর অনেক ছিটমহলের নামও পরিবর্তন হয়েছে।

আগে পরিচয় গোপন করে পড়তাম

পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলে অবস্থিত রাজমহল উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফসানা আখতারের কথায়, ‘এক সময় এখানে স্কুল কলেজ তো ছিলই না, রাস্তাঘাটও ছিল না। এখন আমরা পাকা রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাই। স্কুল যাতায়াতের জন্য আমাদের সাইকেলও দেওয়া হয়েছে।’

পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলের স্কুল ছাত্রী সুরমি আক্তারের ভায়ায়, ‘আমরা আগে পরিচয় গোপন করে পড়তাম। এখন নিজেদের পরিচয়েই পড়তে পারছি। সরকার থেকে আমাদের সাইকেল, স্কুল ব্যাগ দিয়েছে। আমাদের আর কষ্ট করে পড়তে হয় না।’

বোদা উপজেলার শালবাড়ি ছিটমহলের কৃষক শফিউদ্দিন বলেন, ‘সার, কীটনাশক পাইতাম না। উত্পাদিত ধান-চাল, ফল-ফসল হাটবাজারে নিয়ে যেতে পারতাম না। এখন পাকা রাস্তা হওয়ায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। আমাদের উত্পাদিত ফসল সহজেই হাট-বাজারে নিয়ে যেতে পারছি। আমরা এখন অনেক ভালো আছি।’

গাড়াতি ছিটমহলের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজার রহমান বলেন, ‘৩ বছরে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নের চেয়ে অনেক বেশি উন্নয়ন হয়েছে ছিটমহল এলাকায়। ছিটমহলের পাশে বাংলাদেশি এলাকার অনেক বাড়িতে এখনো বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি। কিন্তু বিলুপ্ত ছিটমহলের ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলছে। উন্নত যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, আইনগত সহায়তার ব্যবস্থায় আমরা এখন গর্বিত বাংলাদেশি নাগরিকের মর্যাদা জীবনযাপন করছি।’

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, ছিটমহল এলাকা এক সময় প্রকৃত অর্থেই অবহেলিত ছিল। সেখানকার মানুষের কোনো মর্যাদা ছিল না। এখন তারা নাগরিকত্বের মর্যাদা নিয়ে জীবনযাপন করছেন।

তৃতীয় বর্ষপূর্তি উত্সব

ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা, আনন্দ-উত্সব আর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পঞ্চগড় জেলার ৩৬টি ছিটমহলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের তৃতীয় বর্ষপূর্তি উত্সব উদযাপন করা হয়েছে। দিনটি উপলক্ষে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীরা ৩১ জুলাই রাত ১২টা ০১ মিনিটে শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, মশাল প্রজ্জ্বলন ও মিষ্টি মুখ, পতাকা উত্তোলন, আনন্দ শোভাযাত্রা, খেলাধুলা, বিশেষ মোনাজাত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে। গত ১ আগস্ট পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে ৩ বছরপূর্তি উত্সবের কার্যক্রম শুরু হয়। পঞ্চগড় জেলার সাবেক গাড়াতি ছিটমহলের মফিজার রহমান কলেজ মাঠে পতাকা উত্তোলন করেন পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম। পতাকা উত্তোলন শেষে মফিজার রহমান কলেজ মাঠ থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের হয়। ছিটমহলের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে শোভাযাত্রাটি আবার কলেজ মাঠে এসে শেষ হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ শোভাযাত্রায় অংশ নেন।